আমাদের দেশে বেশ কয়েকটি চিকিৎসা পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত চিকিৎসা পদ্ধতি হলো এলোপ্যাথি। একে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিও (Modern system of medicine) বলা হয় ৷ অন্য যে পদ্ধতি গুলো এখানে আছে এবং অনেক মানুষ এসব পদ্ধতির চিকিৎসা গ্রহণ করে থাকে সেগুলো হলো:
(ক) আয়ুর্বেদিক (Ayurvedic)
(খ) মঘা (Mogha)
(গ) ইউনানী (Unani)
(ঘ) হোমিওপ্যাথি (Homeopathy)
(ঙ) বায়োকেমিক (Biochemic)
(চ) আকুপাংচার (Acupuncture)
(ছ) আকুপ্রেসার (Acupressure)
(জ) ন্যাচারোপ্যাথি (Naturopathy)
(ঝ) এরোমা থেরাপি (Aromatherapy)
(ঞ) গার্হস্থ্য চিকিৎসা (Home remedy)
ইত্যাদি
আধুনিক চিকিৎসার বিপরীতে সবগুলোই লোকজ চিকিৎসা বা বিকল্প চিকিৎসা নামে পরিচিত ৷ এই চিকিৎসা ব্যবস্থায় ব্যবহৃত ওষুধ কে বিকল্প বা প্রাচীন ঐতিহ্যগত ওষুধ বলে। আয়ুর্বেদ আমাদের দেশের সবচেয়ে প্রাচীন চিকিৎসা ব্যবস্থা। ‘আয়ু’ মানে ‘জীবন’ ও ‘বেদ’ মানে ‘জ্ঞান’। সম্ভবত আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে থেকে এদেশে এর প্রচলন হয়। আয়ুর্বেদ স্বাস্থ্যের উৎপত্তি যেখান থেকে সেই বইটির নাম ‘ঋগ্বেদ’।
পরবর্তীতে খ্রীষ্টের জন্মের প্রায় ৮০০ বছর আগে এদেশের বিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী চরক লিখিত ‘চরক সংহিতা’ এবং খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ বছর আগে এদেশের আরেক চিকিৎসা বিজ্ঞানী সুশ্রুত লিখিত ‘সুশ্রুত সংহিতা’ বইয়ের সন্ধান পাওয়া যায়। পরবর্তীতে আরো অনেক বিজ্ঞানী আয়ুর্বেদ শাস্ত্র কে উন্নত করেন। মোগল সম্রাটদের রাজত্বকালের আগে পর্যন্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা হিসাবে আয়ুর্বেদ চিকিৎসারই প্রচলন ছিল। বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশের সাথে সাথে মঘা চিকিৎসা পদ্ধতি বিকশিত হতে থাকে। কথিত আছে যে এক মাঘী পূর্ণিমার রাতে এই চিকিৎসা পদ্ধতির উদ্বোধন করেন স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ ও চিকিৎসা বিজ্ঞানী জীবক। আয়ুর্বেদ থেকে উদ্ভব হওয়ার ফলে আয়ুর্বেদিক ও মঘা চিকিৎসা পদ্ধতি প্রায় একই ধরনের। পার্থক্য শুধু এই যে আয়ুর্বেদ পদ্ধতিতে ওষুধের উৎস উদ্ভিদ, মঘা পদ্ধতিতে ওষুধের উৎস শুধুমাত্র উদ্ভিজ ও খনিজ৷ প্রাণী হত্যা বৌদ্ধ ধর্মে অনুমোদিত নয় বলে কোন প্রাণীজ ওষুধ এই শাস্ত্রে ব্যবহৃত হয় না৷
মোগল শাসকরা মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তান হয়ে এদেশে আসেন। তাদের সাথে ছিল সেই এলাকার চিকিৎসা ব্যবস্থা, যার নাম ইউনানী। এর আদি জন্মস্থান গ্রিসের ইউনান বা হুনান প্রদেশ। সেখান থেকে প্রায় ২০০০ বছর আগে এই চিকিৎসা পদ্ধতি মধ্যপ্রাচ্যে আসে। ইসলাম ধর্মের অভ্যুদয়ের পর আল-রাজি, ইবনে সিনা প্রমুখ বিখ্যাত চিকিৎসকেরা ইউনানী চিকিৎসা পদ্ধতিকে অনেক উন্নত করেন। ভারতবর্ষেও মোগলদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই পদ্ধতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
ইংরেজরা যখন এ দেশে শাসন পরিচালনা করতে থাকে, তখন তারা তাদের সাথে আসা চিকিৎসকদের মাধ্যমে এ দেশে এলোপ্যাথি চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রচলন করে। দীর্ঘ ইংরেজ শাসনামলে ইউরোপে এই পদ্ধতির বৈপ্লবিক উন্নতি ঘটে এবং ভারতবর্ষেও তারা এই জ্ঞান প্রসারিত করে। ফলে ধীরে ধীরে মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল ইত্যাদি গড়ে ওঠে। এভাবে এলোপ্যাথি চিকিৎসা এ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
ইংরেজ শাসনামলের প্রায় মাঝামাঝি সময়ে জার্মানিতে ডাক্তার হানিম্যান হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করেন৷ এলোপ্যাথি দামি ওষুধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার বদলে একটি নিরাপদ ও সস্তা চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে এই পদ্ধতিও একসময় ভারতবর্ষে প্রবেশ করে এবং জনপ্রিয়তা পায়।
বায়োকেমিক ওষুধ প্রায় একই সময়ে জার্মানিতে আবিষ্কৃত হয়। এর মূল কথা হলো অল্প কিছু রাসায়নিক উপাদান দিয়ে মানব শরীরের বহু রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব৷ এদের মতে বায়োকেমিক ওষুধ ও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ামুক্ত ৷ এখন অবশ্য আলাদা করে আর বায়োকেমিক পদ্ধতি দেখা যায় না। এগুলো হোমিওপ্যাথিক পদ্ধতির সাথে একীভূত হয়ে গেছে।
পদ্ধতি আলাদা হলেও এলোপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক, মঘা, ইউনানী এবং হোমিওপ্যাথির ওষুধের উৎস একই। মঘা ও ইউনানী শাস্ত্র যেখানে গাছ-গাছড়ার ওপর নির্ভরশীল, এলোপ্যাথি সেখানে গাছ-গাছড়ার মূল ওষুধি উপাদানটিকে সনাক্ত করে, সেটি দিয়ে ওষুধ তৈরি করতে শুরু করে ৷ অবশ্য বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং গাছ-গাছালি কমে যাওয়ার কারণে গাছ-গাছড়ার মূল উপাদান গুলোকে কৃত্রিমভাবে বা সিন্থেসিসের মাধ্যমে শিল্প কারখানায় তৈরি করা হয়। ফলে বিপুল পরিমাণে ওষুধ উৎপাদনে এলোপ্যাথির জুড়ী নেই।
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার জন্য প্রায় একই গাছ-গাছড়া ব্যবহার করে তবে অন্য পদ্ধতির তুলনায় তাদের বেশি গাছের দরকার হয় না, কারণ তারা গাছের নির্যাস অ্যালকোহলে মিশিয়ে সেখান থেকে পাতলাকরণ বা Dilution-এর মাধ্যমে ওষুধ তৈরি করে। হোমিও শাস্ত্র মতে, যত ডাইলুশন হবে ওষুধের শক্তিও ততই বেড়ে যাবে। এর ফলে হোমিও ওষুধের দাম অন্য সব পূর্বোক্ত পদ্ধতির তুলনায় সবচেয়ে কম রাখা সম্ভব। আর এ কারণেই এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনাও কম ৷ যদিও একেবারে নেই তা সত্য নয় ৷ হোমিও ওষুধ নির্বাচনে ভুল হলে এবং শক্তি বা মাত্রা নির্বাচনে ভুল হলে মারাত্মক পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হতে পারে ৷
আকুপাংচার শরীরের বিভিন্ন স্নায়ুতে সুচ ফোটানোর মাধ্যমে চিকিৎসার পদ্ধতি। প্রায় তিন হাজার বছর আগে চিনারা এই পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল। বর্তমানেও অনেক জটিল রোগ সারাতে এই পদ্ধতি পৃথিবীর দেশের দেশে ব্যবহৃত হয়। আধুনিক কালে সুঁই এর সাথে মৃদু বৈদ্যুতিক আবেশে তৈরি করা হয়৷
আকুপ্রেশার পদ্ধতিতে শরীরে বিভিন্ন অংশে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। শরীরের বিভিন্ন ব্যথাযুক্ত স্থানে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে উপশমের পদ্ধতি আমরা সবাই জানি। মাথা ব্যথা, কোমর ব্যথা, হাত-পায়ের পেশীতে ব্যথা, ইত্যাদিতে সেই জায়গাগুলো টিপে দিলে আমরা আরাম পাই। আকুপ্রেশার এগুলোরই একটি উন্নত সংস্করণ। শরীরের নির্দিষ্ট অংশে নির্দিষ্ট নিয়মে নিয়মিত চাপ প্রয়োগে ওষুধ ছাড়াই বেশ কিছু অসুখ ভালো হওয়ার বিষয়টি এখন অনেক বিজ্ঞানীরই মনোযোগ আকর্ষণ করেছে৷
ন্যাচারোপ্যাথি পদ্ধতিতে বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের জন্য প্রকৃতিকে ব্যবহার করা হয়। রোগীকে তার অভ্যস্ত পরিবেশ থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার ফলে তার জীবন-যাপন প্রণালী, খাদ্যাভ্যাস, মনের সতেজতা ইত্যাদির পরিবর্তনের মাধ্যমে কোন কোন রোগকে আরোগ্য করা সম্ভব। পুরনো গল্প উপন্যাসে আমরা ওষুধ ও পথ্যের পাশাপাশি রোগীর হাওয়া বদল, বায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি অনুষঙ্গের কথা জানতে পারি৷ শহরের যান্ত্রিক জীবনে আমরা যখন হাপিয়ে উঠি, তখন গ্রামে গেলে আমাদের মন প্রফুল্ল হয়, নদীর বুকে ভ্রমণ কালে আমাদের ক্ষুধা বেড়ে যায়, পাহাড়ে বেড়াতে গেলে আমাদের ঘুম ভালো হয় ইত্যাদি সবই ন্যাচারোপ্যাথির উদাহরণ৷
সূত্র: বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল কর্তৃক প্রকাশিত বই থেকে।